
ফরিদগঞ্জ টাইমস ডেস্ক : জীর্ণ শীর্ণ শরীর নিয়ে প্রতিদিন রিক্সা নিয়ে বের হয় শাহাদাত। দুই ছেলে স্ত্রী আর পিতা-মাতা নিয়ে তার সংসার। শরীরের মতো তার সংসারও জীর্ণ শীর্ণ। টেনে-টুনে সংসার চালান। যে রিক্সাটি চালান তাও সমিতি থেকে লোন নিয়ে কিনা। প্রতি সপ্তাহে কিস্তি দেওয়া লাগে। নানান টেনশন নিয়েই প্রতিদিন বের হন। এর মাঝেই ছেলের দুঃসংবাদে যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ে মাথায়।
শাহাদাতের ছোট ছেলে নুরে আলম। বয়স প্রায় দুই বছর। অস্বাভাবিক পেনিস নিয়ে জন্ম তার। খতনা করা অবস্থায় জন্ম নেয়া ভাগ্যের বেপার বলে আত্মতৃপ্তিতে ভুগছিলো তার পরিবার। কিন্তু পেনিসের প্রবাহিত রাস্তাটি যে একেবারেই বন্ধ তা খেয়াল করেনি কেউ। শিক্ষা-দীক্ষাহীন পরিবারটি কখনো কারো সহযোগিতাও চায়নি। প্রস্রাব করার সময় বাচ্চার চিৎকারের ভাষাটুকুও বুঝার চেষ্টা করেনি শাহাদাত পরিবার। অবশেষে প্রায় দুই বছরের মাথায় টনক নড়ে তাদের। কুসংস্কারকে পদদলিত করে অবশেষে শাহাদাত দম্পিত চিকিৎসকের কাছে যান। ফরিদগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের দায়িত্বরত চিকিৎসক জানালেন- ‘তার (নুরে আলম) প্রস্রাবের স্বাভাবিক রাস্তাটি একেবারেই বন্ধ। পাশেই সামান্য ছিদ্র দিয়ে প্রস্রাব যায়। তাই কষ্টে সে চিৎকার করে। এটা অপারেশন করে ঠিক করতে হবে। তবে আমাদের এখানে অপারেশনের সুযোগ নেই। ঢাকায় নিয়ে করাতে হবে।’
অপারেশন খরচের কথা শুনে শাহাদাতের মাথায় হাত। দিক শূণ্য হয়ে সে ফরিদগঞ্জ লেখক ফোরামে আবেদন করে। সংগঠনও তার মানবিক আবেদনে সাড়া দিয়ে নুরে আলমের পুরো চিকিৎসার দায়িত্ব নেয়। সংগঠনের একটি টিম মানুষের দ্বারে দ্বারে। আরেকটি টিম চিকিৎসকদের কাছে। উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. আশরাফ চৌধুরী আরো দু’জন ডাক্তার নিয়ে আন্তরিকতার সহিত ২য় বার নুরে আলমকে দেখেন এবং লেখক ফোরাম টিমকে সুন্দর পরামর্শ দেন।
কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের শিশু ইউরোলজী, কলোরেক্টাল, ভাসকুলার ও নিউরোসার্জারী ডা. মোহাম্মদ মাহবুবুল আলম নুরে আলমকে প্রথম অপারেশন করান। দুই বছর পর ২য় এবং শেষ অপারেশন করাবেন। গত ৩ জুন শুক্রবার ফরিদগঞ্জ ডায়াবেটিস হাসপাতালে নুরে আলমের ১ম অপারেশন হয়। বর্তমানে নুরে আলমের চিকিৎসা ডা. মোহাম্মদ মাহবুবুল আলমের তত্ত্বাবধানে চলছে। শিশু নুরে আলম বর্তমানে অনেকটাই ভালো আছে।
বাজারে বাজারে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে চিকিৎসা তহবিল সংগ্রহ করেছেন লেখক ফোরামের এক ঝাঁক নিবেদীত প্রাণ। এঁদের মধ্যে সবচেয়ে বেশী সময় দেওয়া সংগঠনের সাংস্কৃতিক বিষয়ক সম্পাদক মেহেরাজ হাসান সৌরাভ বলেন, ‘পবিত্র রমজানের আগের দিন থেকে আমরা কাজে নেমে পড়ি। সবার দ্বারে দ্বারে গিয়ে নুরে আলম- রবিউলের জন্য হাত বাড়িয়ে দিয়েছি। রোজার মধ্যেও আমরা থেমে থাকিনি। রোজা রেখে সকালে বের হয়ে ইফতারের আগ মহুর্ত পর্যন্ত কাজ করেছি। হাটতে হাটতে যখন ক্ষুধা আর পানির পিপাসায় ক্লান্ত হয়ে পড়তাম ঠিক তখনই নুরে আলমের নিষ্পাস দু’টি কচি চোখ ভেসে উঠে সামনে; ঠিক তখনই আমাদের সমস্ত অবসাদ দূর হয়ে যায়। ভালো লাগছে আমরা নুরে আলমের চিকিৎসা করাতে পেরেছি।’
নুরে আলমের বাবা শাহাদাত হোসেন বলেন, ‘আমি ফরিদগঞ্জ লেখক ফোরামের কাছে কৃতজ্ঞ। তারা আমার পাশে না দাঁড়ালে ছেলের চিকিৎসা করাতে অনেক কষ্ট হতো। আমি তাদের এই উপকারের কথা ভুলবো না। তারা আমাকে কিছুই করতে দেয়নি। চিকিৎসার সব কাজ তারাই করেছে। এমন কী আমার ছেলেকে বিভিন্ন সময় ফলও কিনে দিয়েছে। মাঝে মাঝে আমার সংসারের জন্য নিত্য প্রয়োজনীয় কিছু পণ্যও কিনে দিচ্ছে। আমার ছেলে এখন সুস্থ। সবাই তার জন্য দোয়া করবেন।’
নুরে আলমের চিকিৎসা টিমের অন্যতম সদস্য ও সাবেক সভাপতি কে.এম নজরুল ইসলাম এ প্রতিনিধিকে বলেন, ‘আমি একজন ব্যবসায়ী মানুষ। ব্যবসার কাজে প্রতিদিনই ব্যস্ত থাকতে হয়। এর মধ্যেও আমি নুরে আলমের চিকিৎসার তহবিল সৃষ্টিতে সময় দিয়েছি। ডাক্তারের কাছেও ছুটে গেছি। সব সময় বন্ধু ফরহাদের সঙ্গে থেকে নুরে আলমের চিকি’ৎসা করিয়েছি। শিশুটি এখন সুস্থ আছে যেনে ভালো লাগছে।’
সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক মো. কাউসার হোসাইন বলেন, ‘একজন অসহায় শিশুর পাশে দাঁড়াতে পেরে ভালো লাগছে।’
সভাপতি মো. কাওসার আহমেদ বলেন,‘ফরিদগঞ্জ লেখক ফোরাম প্রতিষ্ঠার পর থেকে সাহিত্য-সাংস্কৃতিক কর্মকন্ডের পাশাপাশি সামাজিক এবং মানবিক কাজ করে আসছে। তারই ধারাবাহিকতায় নুরে আলমের চিকিৎসা হয়েছে। প্রতিষ্ঠাতা নূরুল ইসলাম ফরহাদের নেতৃত্বে ভবিষ্যতেও এমন মানবিক কর্মকান্ডে আমরা অংশগ্রহণ করবো’।
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. আশরাফ চৌধুরী এ প্রতিনিধিকে বলেন, ‘শিশুটি জন্মগতভাবেই লিঙ্গ জটিলতায় ভুগছিল। আমি হাসপাতালের সিনিয়র ডাক্তারদের সঙ্গে নিয়ে শিশুটিকে দেখলাম। তারপর হাসপাতালের সীমাবন্ধতার কারণে আমরা তাকে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের শিশু ইউরোলজী, কলোরেক্টাল, ভাসকুলার ও নিউরোসার্জারী ডা. মোহাম্মদ মাহবুবুল আলমের কাছে পাঠিয়ে দেই। শিশুটি ডা. মোহাম্মদ মাহবুবুল আলমের চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে ভালো আছে যেনে ভালো লাগছে।’